সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৯ দফা দাবি উঠেছে শাহবাগের মহাসমাবেশ থেকে। সাধারণ শিক্ষার্থী, বামধারার ছাত্র সংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা আজ শুক্রবার বিকেলে মহাসমাবেশ থেকে বিক্ষোভ করেন। সেখানে জানানো হয়, প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত পর্যন্ত শাহবাগে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলবে।
‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ লেখা ব্যানারে এই মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ‘চিৎকার করো মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়, আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়’- গণসংগীতের মধ্য দিয়ে মহাসমাবেশ শুরু হয়। এরপর গণসংগীত পরিবেশন, আবৃত্তি ও পথনাটক পরিবেশন করা হয়।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছন্দে ছন্দে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ধর্ষক লীগের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’, ‘প্রীতিলতার বাংলাদেশে, ধর্ষকদের ঠাঁই নাই, ‘ধর্ষকদের কারখানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, :পাহাড় কিংবা সমতলে, লড়াই হবে সমানতলে’ স্লোগানে বিক্ষোভ করছেন।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব সমাজ থেকে দূর করতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। সামাজিকভাবে ধর্ষকদের ও ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
মহাসমাবেশে বিকেল সাড়ে তিনটার পরপর সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল নিয়ে যোগ দেয়।মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, সরকার একটি মুলো ধরিয়ে দিচ্ছে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি করা হবে বলে আইনমন্ত্রী বলছেন। কিন্তু আইন করে অপরাধ দমন করা যায় না, কখনো যায়নি। সংস্কৃতি বদলাতে হবে, দেশের মানুষের জানমালের অবস্থান বদলাতে হবে। একটা নিরাপদ, সাম্যের সমাজ গঠন করতে হবে সকলের জন্য।
এই মহাসমাবেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ চৌধুরী, রেহনুমা আহমেদ প্রমুখ। আরও সংহতি জানায় বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ড. ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘সংগঠিত ভণ্ডামি’ চলছে মন্তব্য করে মহাসমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, এই রাষ্ট্রটাই প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র তো মায়ের মতন, এই দেশে যে অন্যায্যতা চলছে, তা স্বীকার করেই প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র ধর্ষিত হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে নানান উপায়ে ধর্ষিত হচ্ছি। আর ধর্ষকদের পাহারা দিচ্ছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, আমরা কেউ নিরাপদ নই। এটাই বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র। কারও কোনো নিরাপত্তা নেই। যারা ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত তারা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত দেখা যাচ্ছে।
এ ছাড়াও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নারী সেলের সদস্য জলি তালুকদার, নারী সংহতির দপ্তর সম্পাদক নাসরিন আকতার, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াকত আলী, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান প্রমুখ। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মহাসমাবেশে বক্তব্য শেষে শুরু হয় প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশন।
৯ দফা দাবি
মহাসমাবেশ থেকে নয় দফা দাবি তুলে ধরেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। দাবিগুলো হলো-
১. সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ
২.নারীদের ওপর সব ধরনের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করা
৩. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৪. ধর্মীয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশে নারী বিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞানে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।
৫. তদন্তকালে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন—হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
৭. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭৯-১৫৫ (৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৮. পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যেকোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।
৯.সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে হবে।
সমাবেশ থেকে বলা হয়, ১৫ অক্টোবরের মধ্যে নয় দফা দাবি মানা না হলে ১৬ অক্টোবর সকাল ৯টায় শাহবাগ থেকে বেগমগঞ্জের উদ্দেশ্য লংমার্চ ও ১৭ অক্টোবর বেগমগঞ্জে সমাবেশ করা হবে।
প্রতিবাদী কর্মসূচি
মহাসমাবেশ থেকে প্রতিবাদী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়। কর্মসূচিগুলো হলো ১১ অক্টোবর ধর্ষণবিরোধী আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ১২ অক্টোবর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১৩ অক্টোবর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ১৪ অক্টোবর নারী সমাবেশ ও ১৫ অক্টোবর ঢাকায় সাইকেল র্যালি।
এর আগে বেলা তিনটার দিকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ করে ‘সেভ আওয়ার উইমেন’ নামের শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম।
ফেসবুকভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘সেভ আওয়ার উইমেন’ এর সদস্য বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৮৩ হাজার। প্ল্যাটফর্মটি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচেতনতায় কাজ করছে। এর সভাপতি সানজিদা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মেয়েরা ভীত ও শঙ্কিত। এ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করার কথা ছিলো না। জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই তাই আমরা রাজপথে। ধর্ষণ কেন হচ্ছে এটা বের করতে হবে। ধর্ষকেরা নিশ্চয়ই আগে অপরাধ করেছিল, সেটার বিচার হয়নি। তাই সে আবার অন্যায় করেছে।’
ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে একই সময়ে জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্লাডওয়ালা, হেল্পিং হ্যান্ড বাংলাদেশ ও এনএস ফোরাম।