ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যায় ভেসে গেছে প্রায় ১৯ কোটি টাকার মাছ
অতিবৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট সম্প্রতি বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলা। বন্যায় অন্তত ৬০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় আখাউড়া উপজেলা ও কসবা উপজেলা। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের ও খামারের মাছ। এছাড়াও অতিবৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয়ে জেলা সদর ও বিজয়নগর উপজেলায়ও পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে মৎস্য চাষিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলমান অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ৪ উপজেলার ৮৬০টি পুকুরের অন্তত ৭৫৬টন মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এতে সাড়ে ১৮ থেকে ১৯ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন আখাউড়া উপজেলার খামারিসহ মাছ ব্যবসায়ীরা। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।
আখাউড়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় পুকুর, দিঘি ও খামারের সংখ্যা ২ হাজার ৩৪৮টি। এগুলোর মোট আয়তন ৬২১ হেক্টর।এসব জলাশয়ে প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ী মাছ চাষ করেন। আর চাষির সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। বন্যায় ১২১ দশমিক ৮৬ হেক্টর আয়তনের ৪৩০টি দিঘি, খামার ও পুকুরের ৪৫৬ টন মাছ পানিতে ভেসে গেছে। যার মূল্য ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আর ১ কোটি ১৫ লাখ পোনা পানিতে ভেসে গেছে যার বাজারমূল্য ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ১০ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
আখাউড়ার সাহেবনগর গ্রামের খামারি ও তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ সোহাগ বলেন, উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের ৭টি বড় বড় পুকুরে তেলাপিয়া, রুই, কার্প, কাতলসহ কোটি টাকার মাছ চাষ করেছিলাম। কিন্তু বন্যার পানিতে আমার সবগুলো পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। আমাদের এখন পথে বসা ছাড়া উপায় নেই। একজন তরুণ উদ্যোক্ত হিসেবে আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, মৎস্য চাষীদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সরকার যেন সহজ শর্তে ঋণ ও অথবা সুদমুক্ত ঋণের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করেন।
মোগড়া ইউনিয়নের নিলাখাদ গ্রামের খামারি নাইম আহমেদ বলেন, ‘বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা সামলে ওঠা অনেক কঠিন। বন্যার পানিতে পাঁচ কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করব, বুঝতে পারছি না।’
মৎস্য খামারী ইব্রাহিম ভুইয়া লিটন বলেন, আমার ৪টি পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। পানি কমলেও আমার পুকুরে আর মাছ নেই। এতে আমার ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি-সংক্রান্ত প্রাথমিক একটি তালিকা করেছে আখাউড়া উপজেলার মৎস্য কার্যালয়। উপজেলার মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে খামারিদের ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
এদিকে কসবা উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বন্যার পানিতে ২০০ পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। এগুলোর আয়তন ৩৮ হেক্টর। ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার বড় মাছ ও ১০ লাখ টাকার পোনা পানিতে ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো ভেঙে মোট ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানাযায়, আখাউড়া ও কসবা উপজেলা ছাড়াও অতিবৃষ্টির কারণে সদর উপজেলায় ৬০ হেক্টর আয়তনের ১৪৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ১২ লাখ পোনা ও ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার বড় মাছ পানিতে ভেসে গেছে। অবকাঠামো ভেঙে যাওয়াসহ বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ায় মোট ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি বিজয়নগর উপজেলায় ১১ হেক্টর আয়তনের ৮৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ১৩ লাখ টাকা মূল্যের ১ লাখ পোনা ও ৪০ লাখ টাকার বড় মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো ভেঙে যাওয়ায় মোট ৫৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন, বন্যার পানিতে ৮৬০টি পুকুর প্লাবিত হয়ে সাড়ে ১৮ থেকে ১৯ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। খামারি ও ব্যবসায়ী মিলিয়ে ৮৬০ জন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে গেলে পুনঃরায় নীরিক্ষণ শেষে ক্ষতিগ্রস্থদের সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া হবে। সেখান থেকে যেই সহযোগিতা ও প্রণোদনা আসবে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, ২০ আগস্ট রাতে ভারতের পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্তবর্তী আখাউড়া উপজেলার হাওড়া নদীর বাঁধের ৩টি অংশে ভাঙন দেখা দেয়। এতে আখাউড়ার ৪০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়। এছাড়াও পাহাড়ি ঢলের কারণে কসবা উপজেলারও ৩টি ইউনিয়নও প্লাবিত হয়ে যায়।