শরীরে তাজা গুলি নিয়ে বিছানায় ছটফট করছে রনি
নিজস্ব প্রতিনিধি ফরিদপুর
শরীরে তাজা গুলি নিয়ে বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মো. রনি (৩০)। ৫ আগস্ট চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন রনি।
সেই থেকে শরীরে তাজা বুলেট বয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিনিদ্র রাত কাটছে তার। বর্তমানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এলেও যন্ত্রণা আর অনিশ্চিত বেঁচে থাকার শঙ্কা নিয়ে মানবেতর দিন পার করছে সে। একদিকে ঋণের বোঝা, সংসারের অভাব-অনটন, দুধের শিশুর খাবার জোগান আর ভবিষ্যৎ চিকিৎসার দুশ্চিন্তায় বিছানায় শুয়ে শুয়েই চোখের পানি ফেলছেন। গুলিবিদ্ধ হবার চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনও মেলেনি সরকারি কোনো সহায়তা, খোঁজ নেয়নি সরকারের কোনো দপ্তর। রনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের দৈত্যরকাঠি গ্রামের এনামুল হাসেনের ছেলে। তিনি এক সন্তানের জনক। রনি রাজধানীর একটি কনস্ট্রাকশন সাইড দেখাশোনার কাজ করতেন।
রনির সাথে আলাপকালে জানা যায়, ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলি হয়। সেই গুলিতে তার মুখগহবর ছেদ করে মেরুদন্ডের হাড়ের ডিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হয়। এতে তার ঠোঁট, সামনের ৮টি দাঁত, জিহবা, মুখগহবরসহ মেরুদন্ডের হাড়ের ডিস্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টানা তিন মাস বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়িতে অবস্থান করছে সে।
আন্দোলনের শুরু থেকেই তার দায়িত্বে থাকা প্রকল্পটি বন্ধ থাকায় ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সাথে একাত্ম প্রকাশ করে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিনের মতো ৫ আগস্ট সকাল বেলা ছাত্র-জনতার সাথে বিক্ষোভরত অবস্থায় রাস্তায় ছিলেন রনি।
গুলিবিদ্ধ হাবার পর ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান রনি। আন্দোলনকারী অন্যান্য ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে মীরপুরের পূর্ব মনিপুর থেকে ছুটে আসেন রনির পিতা এনামুল হোসেন। ইউনাইটেড হাসপাতালেই প্রাথমিক চিকিৎসা চলে রনির। সেখানে বেলা সাড়ে তিনটা থেকে রাত অবধি জটিল অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করতে ব্যর্থ হন চিকিৎসকগণ। অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বহন করতে হয় পরিবারের। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করার সামর্থ্য না থাকায় রাতেই সেখান থেকে ধানমন্ডির পপুলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে স্থানান্তর করেন পিতা এনামুল হোসেন। পপুলারে ১৮ দিন চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা সেবা নিয়ে ব্যয় মিটাতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এ সময় এক সমন্বয়কের মাধ্যমে শুধু মাত্র ঔষধের বিল পরিশোধ করে ছাড় পান তারা। পপুলার হাসপাতালের ঔষধের বিল পরিশোধ করতে আত্মীয়-স্বজন, গ্রামবাসী ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার থেকে ঋণ নিতে হয় রনির পরিবারকে। পরে সমন্বয়কদের মাধ্যমে সাভার সিআরপি হাসপাতাল ও ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সর্বশেষ সিআরপিতে কয়েক ঘণ্টা ও ইবনে সিনায় ২ মাস ৭ দিন ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলে রনির। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাসের চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের বাম অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রায় প্যারালাইসড হয়ে পড়া শরীর নিয়ে কিছুটা হাঁটা চলা করতে পারলেও শরীরে বয়ে বেরানো তাজা বুলেটের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি। ঘুমাতে পারেন না পরিবারের অন্য সদস্যরাও। দিনরাত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হচ্ছে রনিকে। সব সময় কাউকে না কাউকে তার পাশে থাকতে হয়। তাই, তার মা, স্ত্রী ও বোন পালাক্রমে পাশে থাকে তার। তারা আরও জানান- রনির বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতিতে মেরুদন্ডের হাড়ের মধ্যে গেঁথে থাকা গুলি অস্ত্রোপচার করে বের করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ জন্য আরও সময় লাগবে। তবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে হয়ত অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা সম্ভব। কিন্তু একদিকে ধারদেনা, ঋণের বোঝা অন্য দিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম বাপ-বেটা বেকার। বর্তমানে অভাবের সংসারে দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোগান দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে রনির পরিবারের।
রনির পিতা এনামুল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আন্দোলনের শেষ দিন আমার সন্তান গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকায় থাকতে অনেকে এসেছে, নাম ঠিকানা নিয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভালো চিকিৎসাসহ আর্থিক সহায়তার। ছেলের পিছনে ঋণ করে, গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা তুলে ৬/৭ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন আমি নিঃস্ব রিক্ত। জানিনা আমার ছেলেটার চিকিৎসা শেষ করতে পারবো কিনা।
আহত রনির স্ত্রী শান্তা ইসলাম বলেন, আমার স্বামী আজ চার মাস গুলিবিদ্ধ, শরীরে তাজা গুলির যন্ত্রণা নিয়ে সারাক্ষণ ছটফট করে। রাতে ঘুমাতে পারেনা। স্ত্রী হয়ে এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারিনা। সরকারের নিকট জোর দাবি জানাই, সরকার যেন তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। যাতে সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়।